(সারার সাথে ঝগড়া)
হঠাৎ কে যেনো অনেক দুর থেকে ডাকছে “নাজমুল …নাজমুল …নাজমুল, আর ইউ ওকে? নাজমুল, আর ইউ লাইভ?”
চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি সারা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে | সারার চোখ-মুখটা ফুলা, রেড কালারের ড্রেস পরা | সকালে সে ব্ল্যাক ড্রেস পরা ছিলো কিন্তু এখন রেড |
আমার প্রচন্ড টায়ার্ড লাগছে, অনেক কষ্টে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম | বুঝতে পারলাম, দোয়া পড়তে ঘুমিয়ে পরেছিলাম | এই জন্য হয়তো মনে হচ্ছিলো দূর থেকে কেউ ডাকছে, আসলে সারা আমার সামনেই ছিলো | সারাকে দেখে যেমন সাহস পেলাম তেমন রাগও হলো, কেন তার আসতে এতো দেরি হলো ? কিন্তু আমার রাগটা প্রকাশ করলাম না | প্রকাশ করার মতো এনার্জি, ইচ্ছা ও সময় কোনোটাই ছিলো না |
সারাকে বললাম আমার কাজ শেষ, তুমি সার্ভারে লগইন করে সব চেক করে নাও| সারা সার্ভার এর সামনে দাঁড়িয়ে লগইন করছিলো আর বার বার বলছিলো “আই এম সো সরি নাজ, আই ডিড ম্যাসআপ”| ১৫ মিনিট পর সারা বললো “নাজ এভরিথিং ওকে, লেটস গো” |
আমি সার্ভিস রিপোর্ট রেডি করতে গিয়ে চিন্তায় পরে গেলাম, চেক-আউট টাইম কয়টা লিখবো ! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ৯:৪৫, মানে আমি অলমোস্ট ১২ ঘন্টা এই কাজে আটকা আর সেটা তো রিপোর্টে লিখতে পারবো না। আর আমার বস এই কাজের জন্য ১২ ঘন্টা ওভার টাইম দিবে না | আর তাই চেক-আউট টাইম দুপুর ১:০০টা লিখে সারা কে বললাম, রিপোর্টে সাইন করো | সারা বললো নাজ, ক্যান ইউ রাইট চেক-আউট টাইম টেন পিএম? সারা কে বুঝালাম ২ ঘণ্টার কাজ করতে এসে ১২ ঘন্টা আটকে ছিলাম, আর এটা আমার বসকে আমি ১২ ঘন্টা ওভার টাইম জাস্টিফাই করতে পারবো না | সারা আর কথা না বলে সার্ভিস রিপোর্টে সাইন করে দিলো |
ডাটা সেন্টার থেকে বের হয়ে সোজা সমারসেট ট্রেন স্টেশনে চলে আসলাম | সারা আমাকে ফলো করতে করতে ট্রেন স্টেশনে চলে আসলো, আর বার বার ডিনার করতে আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল | বুঝতে পারলাম আমাকে ডিনার করাতে পারলে সে নিজেকে হয়তো হালকা করতে পারবে, কিন্তু আমার মাথায় এসব কিছু যায় আসে না কারণ মৃর্ত্যুর কূপ থেকে বেঁচে এসেছি এর চেয় বড় কি হতে পারে |
পর দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ১১ টা মেসেজ, সব গুলোতেই একটা কমন শব্দ সরি | বুঝতেই পারলাম এটা সারার মোবাইল থেকে এসেছে | কোনো উত্তর না দিয়ে মোস্তফা এলাকায় গিয়ে গুরু ট্রাভেলস থেকে ঢাকার রাতের ফ্লাইটের টিকেট কাটলাম | বস কে একটা মেসেজ দিয়ে, মোবাইল অফ করে ১ দিনের আর্জেন্ট লিভ সহ ৩ দিনের জন্য ঢাকা চলে গেলাম |
যেদিন ঢাকা থেকে ব্যাক করে মোবাইল অন করে দেখতে পেলাম সারা এই কদিনে ৩০ বারের বেশী কল দিয়েছে, ১৫ টার ও বেশি এসএমএস দিয়েছে | অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম সারা অনেক বার অফিসেও কল দিয়ে জানতে চেয়েছে আমি কোথায় | বুঝতে পারলাম ও কিছু একটা বলতে চাচ্ছে | এবার ওর মেসেজের আনসার দিলাম “হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট”? সারা আনসার দিলো “লাঞ্চ এট কেঅফসি ১২:৩০পিএম শার্প এট বুগিস জাঙ্কশন ” | আমি রিপ্লাই দিলাম ওকে |
এটাকে আপনি ডেট লাঞ্চ বলতে পারেন কিন্তু আমার জন্য ছিলো কৌতুহলী লাঞ্চ | আমার জানার খুব আগ্রহ ছিলো, সেই দিন কি হয়েছিলো? কেনো সে ১২ ঘন্টা পরে ডাটা সেন্টারে এসেছিলো? কি এমন জরুরী কাজ ছিলো তার? সব এনসার জানতে লাঞ্চ করতে চলে গেলাম | গিয়ে দেখি সারা আমার জন্য খাবার সহ টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে | সিটে বসে জিজ্ঞাস করলাম কি হয়েছিলো সেদিন? সারা বললো কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছিনা | আমি বললাম ডাটা সেন্টারে আমাকে রেখে কোথায় গিয়েছিলা? এবার সারা শুরু করলো ….
তোমাকে রেখে আমি আমার বয়ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম | আমরা একসাথে লাঞ্চ করে, মুভি দেখে, কেনাকাটা করে একটা কফি শপে বসে যখন কফি খাচ্ছি হটাৎ ওর মোবাইলের মেসেজ এ গিয়ে দেখি কিছু প্রাইভেট ইন্টিমেসি মেসেজ যেটা ও ওর আগের গার্ল ফ্রেন্ড কে লিখা | ও আমার সাথে প্রমিস করেছিল তার সাথে আর কোনো দিন যোগাযোগ করবেনা | ওইটা দেখে আমার মাথা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো | রেগে গিয়ে ওর আর আমার মোবাইল ভেঙ্গে ফেলেছি | ওর সাথে অনেক ঝগড়াও হয়েছে, তারপর রাগে বাসায় গিয়ে কান্নাকাটি করেছি, এবং গোসল করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম |
আমি রেগে গিয়ে বললাম তুমি কি মানুষ নাকি কচ্ছপ ? আমাকে মৃত্যুর কূলে ফেলে দিয়ে তুমি বাসায় গিয়ে ঘুমাচ্ছ ? ওর মুখ লাল হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে আর কিছু বললে কেঁদে ফেলবে | এবার নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বললাম তার পর কি হলো? তোমার বয়ফ্রেন্ড বুঝি তোমার বাসায় এসে আমাকে রক্ষা করতে বললো ? ও আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে আবার বললো “নাজ আই এম রিয়েলি সরি” | তার পর আবার শুরু করলো … ঘুম থেকে উঠে টিভি তে মুভি দেখতে ছিলাম হটাৎ মনে হলো ওর কাছে একটা চিঠি লিখি – আওয়ার রিলেসন এন্ড হেয়ার | লিখতে গিয়ে স্টাডি ডেস্ক এ একটা সুন্দর সান মাইক্রোসিস্টেম এর কলম পেলাম | তখন চিন্তা করতে ছিলাম কলমটা কোথায় পেলাম, পরে সব মনে পড়েছে …সকালে তুমি দিয়েছিলে আর তুমি তখন ডাটা সেন্টারে হয়তো আটকা আছো | তাই তাড়াতাড়ি ডাটা সেন্টারে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি …| তার পরের সবই তুমি জানো .. বলে সে চুপ করে আছে |
আমি বললাম, যা হয়েছে সব ভুলে যাও কিন্তু আর কখনো এই রকম করোনা | লাঞ্চ এর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, আমাকে এখন অফিস যেতে হবে | যখন চলে আসবো তখন পিছন থেকে ডেকে বললো, নাজ আই থিঙ্ক আই লাইক ইউ | আমি হেসে বললাম, “ডোন্ট গো বিয়ন্ড দিস” |
এটা ছিলো ২০০৭, তখন ও হোয়াটসআপ, ভাইবার, ফেইসবুক ছিলোনা আর তাই যোগাযোগ বলতে মোবাইল, মেসেজ | ৩ দিন হয়ে গেছে এর মধ্যে সারা অনেক গুলো মেসেজ দিয়েছে যার কোনোটার উত্তর আমি দেইনি | একদিন সকালে আমাদের কল সেন্টার থেকে কল দিয়ে পলিন জানালো আমাকে আর্জেন্ট সিংটেল যেতে হবে, একটা সার্ভার এ প্রবলেম হয়েছে | আমি ভেবেছিলাম সারা আর তাই কল সেন্টার পলিন কে জিগাস কলাম কাস্টমার এর নাম কি? ও বললো মিঃ তান | আর কোনো প্রশ্ন না করে সোজা চলে গেলাম সিংটেল এর সেই ডাটা সেন্টারে | কিন্তু গিয়ে দেখি সারা দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য | দেখে আমার মেজাজ খারাপ হলো কিন্তু কিছু বললাম না | গিয়ে ওকে বললাম আমি মিঃ তান এর সাথে মিট করতে এসেছি | ওনার একটা সার্ভার এ প্রব্লেম হয়েছে |
সারা বললো মিঃ তান আমার বস, সে ছুটিতে আছে, আমি তার নাম দিয়ে কেস লগ করেছি যেনো তুমি বুজতে না পারো | ওর কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে, কিন্ত নিজেকে কন্ট্রোল করলাম | বললাম, “কোন সার্ভার এ সমস্যা হয়েছে ? আমাকে নিয়ে চলো “| ও বললো, সার্ভারের এ আমি সমস্যা করেছি আমি নিজেই ফিক্স করতে পারবো | আমি তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্য এই কেস লগ করেছি এবং কল সেন্টারে রিকোয়েস্ট করেছি যেন তোমাকে এই কাজে এসাইন করে, কারণ তুমি আমাদের সেটআপ সমদ্ধে ভালো জানো |
এই বার আমি রেগে গেলাম, বলাম তোমার মাথা খারাপ !! আমার আর কাজ নাই, অফিসের সময়ে তোমার সাথে ডেটিং করবো | তাছাড়া তোমাকে আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আমি বিবাহিত | আমার মনে হলোনা সারা আমার কথা বিশ্বাস করেছে ! সে আবার বললো, নাজ আই থিংক আই ফল ইন লাভ উইথ ইউ | আমি আবার বললাম সারা তুমি ভুল করছো | আই এম নোট ইউর টাইপ | আমি সত্যি বিবাহিত | সে আবার বললো “নাজ, আই টোল্ড এভরিথিং টু মাই মম এন্ড সি ওয়ান্টস টু মিট ইউ” | বুঝেত পারলাম ও আমার কথা বিশ্বাস করছে না |
এবার আমার মোবাইল থেকে আমার আর আমার ওয়াইফ এর কিছু ছবি দেখলাম | বললাম এই গুলো আমাদের বিয়ের ছবি | সারা আমার হাত থেকে মোবাইল টা নিয়ে অনেক বার একটা একটা করে ১৫-২০ টা ছবি দেখলো | ছবি দেখেই যেকেউ সহজেই বুঝতে পারবে ওই গুলি আমাদের বিয়ের ছবি | সে ছবির প্রোপারটিস দেখে ডেট ও কন্ফার্ম হলো এই গুলি কয়েক মাস আগের ছবি | ভালো করে খেয়াল করলাম সারার চোখ দিয়ে টপ করে পানি পড়ছে | সারা আমাকে বললো নাজ ইউ ক্যান গো নাউ |
আমি সারার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারলাম | ওকে হালকা করতে বললাম আমার ওয়াইফ খুব শিগ্গির সিঙ্গাপুরে আসছে | ও আসলে আমি তোমাকে ডিনার এর ইনভাইট করবো | সারা বললো নাজ আই এম সরি ফর হোয়াট হ্যাপেপনড, বাট ডোন্ট ট্রাই টু কন্টাক্ট মি এনিমোর | আমি আর কিছু না বলে চলে আসলাম |
বেশ কদিন পর আমার এক বন্ধুর সাথে লাঞ্চ এ দেখা, নাম জেফ্রি | ও বললো নাজ তোমার গার্ল ফ্রেন্ডটা আমার খুব পছন্দ | সে দেখতে একদম হায়ুন জুন এর মতো | আমি আবার জিজ্ঞাস করলাম কার কথা বলছো সারা? কার মতো, ও বললো কোরিয়ান অক্টর্স হায়ুন জুন | তুমি কি “মাই সাসি গার্ল – My Sassy Girl” মুভিটা দেখেছো ? আমি বললাম না | ও বললো আজ রাতে বাসায় গিয়ে অবশই ডাউনলোড করে মুভিটা দেখবে !
আমি অফিসে এসে ইন্টারনেট এ সার্চ করে দেখলাম সত্যি সারা দেখতে অলমোস্ট হায়ুন জুন এর মতো | এর পর শুধু সারার কথা মনে করে ওই My Sassy Girl মুভিটা ৫-৭ বার দেখেছি | আমার ওয়াইফ সিঙ্গাপুরে আসার পর ও ওকে নিয়ে বেশ কয়েক বার মুভিটা দেখেছি | এর পর থেকে সারা নামটা শুনলেই কেন যেনো সারা আর My Sassy Girl এর ক্যারেক্টরতা চোখের সামনে ভাসতে থাকে |
নাজমুল খান,
সিঙ্গাপুর থেকে ।
আজ এই পর্যন্তই …| পরের পর্বে জানাবো সারা কিভাবে আমার ….ভাবী হলো | ভালো লাগলে জানাবেন, ভুল হলে ক্ষমা করবেন |
আমার প্রবাস জীবনের ১৫ বছরের ঘটে যাওয়া গল্প থেকে ১৫ টি গল্প আপনাদের সাথে শেয়ার করবো |